পৌষের শেষ অধ্যায়

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

জ্যোতি হাসান
  • ২৯
  • ২৪
প্রথম অধ্যায়ঃ
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি,ধূসর কুয়াশা ঢাকা সকাল, তখন ৮টার কিছু বেশি বাজে। শৈত্য প্রবাহের কারণে ভালো ঠান্ডা পড়েছিলো সেদিন দেশজুড়ে। শাহাবের বয়স তখন মাত্র চার। চার বছরের শিশুর মাথায় খুব বেশি স্মৃতি থাকার কথা নয়, কিন্তু শাহাবের মস্তিষ্কের নিউরনে নাটকের প্রতিটা অংক সাজানো আছে আজও। বাবা-মার কর্কশ চিৎকারে শিশু শাহাবের ঘুম ভাঙে, ঘুম ভাঙ্গার পর সেই চিৎকার-চেঁচামিচি শাহাবের কচি মনকে ভীত করে তোলে। বিছানায় বসে কান্না জুড়ে দেয় ছোট শাহাব। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো মা এগিয়ে এসে শাহাবকে কোলে তুলে নেয় না। শাহাবের কচি কণ্ঠের রোদন তাদের কানে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়। বাবা-মার চিৎকার আরও উঁচুতে উঠে, শাহাব কান্না থামিয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে, গুটি গুটি পায়ে পাশের ঘরে যায়। বাবা-মায়ের ঝগড়া তখন দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শাহাব তার কচি কণ্ঠে বাবা-মার দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যর্থ চেস্টা করে কয়েকবার, “আম্মি-আব্বি, শুনো...” কিন্তু শাহাবের রোদনটা পরিণত হয় অরণ্য রোদনে। মার কথাগুলো এখনও শাহাবের কানে বাজে, “আমার সিদ্ধান্ত এটাই, আমার যাওয়া কেউই আটকাতে পারবে না, আমি তোমার সংসারে থেকে আমার জীবন নষ্ট করবো না।” এটাই ছিলো শায়েলার শেষ কথা। তারপরই কোন দিকে না তাকিয়ে একটা ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে শায়েলা হাবিব সাহেবের বাড়ি এবং জীবন থেকে বেরিয়ে যায়।
এখন ২০১১ সাল, এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও, শাহাব ভুলতে পারে না কিছুই। নাটকের শেষ দৃশ্যগুলোর কথা ভাবলেই শাহাবের কুয়াশায় ঢাকা ঠাণ্ডা একটা দিনের ছবি শাহাবের মনে ভেসে উঠে। তারপরই শাহাবের মাথা গরম হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ভেসে উঠে শায়েলার মুখ, যে মুখ শাহাবের হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। ভয়ঙ্কর ক্রোধ দানা বাঁধে শাহাবের মনে, নিজেকে মনেহয় অবাঞ্ছিত এই পৃথিবীতে। তার নিজের মা, জন্মদাত্রি মা কিভাবে অবহেলায়, অবলীলায় তাকে ফেলে রেখে চলে গেলো সারা জীবনের জন্য!! সারা পৃথিবীটাকে ভেঙ্গেচুরে দিতে ইচ্ছা করে ওর সেই মুহূর্তও গুলোয়!!!
শাহাবের মনে শান্তি নেই একফোঁটাও। যদিও বাবা আর্থিক দিক থেকে শাহাবকে কোন অভাব বুঝতেই দিচ্ছেন না, উপরন্তু শাহাবের ক্লাসের সুবিধার জন্য এক বিশাল কালো প্রাডো জীপও কিনে দিয়েছেন...যেটা বর্তমানে ড্রাইভার চালাচ্ছে। কিন্তু হাবীব সাহেব বুঝতে চাইছেন না তার নিজের ছেলের নিঃসঙ্গতা, তার ছেলের মানসিক টানাপোড়নটা। শায়েলা বাড়ি ছাড়ার কিছুদিন পার না হতেই শাহাবের বাবা হাবীব সাহেব পুনরায় বিয়ে করেন কিন্তু উনার সেই বিয়েও বেশিদিন টিকে না। তারপর আবার উনি বিয়ে করেন....এখন বিয়েটা হাবিব সাহেবের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শাহাবের নাম নাকি রাখা হয়েছিলো তার মা এবং বাবার নাম মিলিয়ে, আর তাই বুঝতে শেখার পর শাহাব ঘৃণা করছে নিজেকেই!!
আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ঘুম ভাঙ্গালো শাহাবের। শীতে জড়সড় হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে ছিল শাহাব, ঘুমের ঘোরে কখন ওর ব্লেংকেটটা গা থেকে সরে গিয়েছে ও জানে না! ব্লেংকেটটা উঠিয়ে নিয়ে গায়ে দিলো শাহাব, ওর বন্ধুদের কাছে শাহাব তাদের মায়েদের স্নেহ আর আদরের বিভিন্ন গল্প শুনতে পায়। ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু মালিহার মা নাকি এখনও মাঝরাতে উঠে মালিহার ঘরে ঢুকে মালিহার ব্লেংকেটটা ঠিক করে দেয়। অথচ শাহাব যদি ওর ঘরে মরে পরেও থাকে তাও কেউ নাই ওর খোঁজ করার। এইসব ভেবে এই কনকনে ঠাণ্ডায়ও শাহাবের মাথা গরম হতে থাকে, সবকিছু ভেঙ্গে চুড়ে ফেলতে চায় ও। অস্থিরতার মাত্রা এতোটাই বেড়ে যায় যে, শাহাব আর শুয়ে থাকতে পারে না। বিছানা থেকে নেমে ঘরের ভিতর পায়চারী শুরু করে। এই সময় শাহাবের দৃষ্টি পড়ে দেয়ালে ঝুলানো বড় ডিজিটাল ঘড়ির উপর, ঘড়িতে সময় সকাল ৯টা বাজতে কিছু বাকি। আর আজকের তারিখটাও জ্বলজ্বল করছে, তারিখটা দেখে শাহাবের মনে পরে যায় সেই দিনের কথা, যেদিন তার মা তাকে ময়লা কাগজের মতো ওয়েস্ট পেপার বিনে ফেলে চলে গিয়েছিলো। এইদিনটা শাহাবের জন্য একই সাথে গভীর বেদনার এবং অপমানের। শাহাব ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে না। ওর চোখের সামনে সারা পৃথিবীটা দুলছে। প্রচণ্ড শীতটাও অনুভব করতে পারে না ও, পাতলা একটা টিশার্ট পরেই ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে যায় ও। আজ প্রচণ্ড জিঘাংসা অনুভব করে ও। কোন কিছু ধ্বংস না করলে ওর মনের এই জ্বালা মিটবে না আজ। ড্রাইভারকে গাড়িতে উঠতে দেয় না ও। ড্রাইভার কিছু বলতে চাইলে তার দিকে মারমুখি হয়ে তেরে যায় শাহাব। ভয়ে ড্রাইভার ওকে বাঁধা দেয় না। টালমাটাল ভাবে চালিয়েই বিশাল জীপ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় শাহাব।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
রুমির মনটা আজ খুব ফুরফুরা। দীর্ঘ সাত বছর পর আজ রুমি তার মার বাড়িতে যাচ্ছে। আজ বিকালের ট্রেনে রুমি তার ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি রওনা হবে। বিয়ের পরপরই এক ঈদে বাড়িতে গিয়েছিলো, তারপর আর যাওয়া হয়নি রুমির। সুদীর্ঘ সাতটি বছর, রুমি তার ছোট ভাইবোনদের, আত্মীয় স্বজনদের দেখেনি। অবশ্য, রুমির ছেলে এবং মেয়ে হবার সময় রুমির মা কিছুদিন এসে থেকে গিয়েছিলো। রুমির বড় ভাই আর বাবাও ঢাকা এসেছে বেশ কয়েকবারই, প্রতিবারই রুমির বাসায় থেকেছে। আর মোবাইলে দুই বেলা সবার সাথে কথা হয়। তারপরও নিজের বাড়িটা দেখার জন্য রুমি ভিতর ভিতর ছটফট করছে। অবশ্য এটা ভেবে রুমির মন খারাপ হচ্ছে যে, নিজের বাড়িতে দিন দুয়েক থেকেই রুমিকে পাশের গ্রামে শ্বশুর বাড়ী যেয়ে থাকতে হবে সপ্তাহখানেক, তারপর আবার ঢাকায় ফিরার সময় দিনদুয়েক থাকতে পারবে রুমি তার মার বাসায়। রুমির এই চারদিন থাকাটাও হতো না যদি না রুমির শ্বশুর বাড়ি থেকে ট্রেন ধরা যেত। ভাগ্যভালো, রুমির শ্বশুরবাড়ি যে গ্রামে ওখানে ট্রেনের লাইন নেই। ইস্ কত বছর পেরিয়ে গেলো, রুমির স্মৃতিও এখন আবছা হয়ে আসছে, কেমন আছে সবাই ওখানে!!
“কইগো, আমার নাস্তা কই?! বক্সে আমার দুপুরের খাবারটা কি ভরে দিয়েছ?!” মানিকের চিৎকারে ঢাকার দুইরুমের ছোট বাড়িতে ফিরে আসে রুমি। “এইতো নাস্তা-দুপুরের খাবার সব তৈরি, টেবিলে বস, নিয়ে আসছি।” ট্রেতে রুতি-সব্জি-ডিম ভাজি সাজিয়ে খাওয়ার টেবিলের দিকে এগোয় রুমি। বারান্দার একটা অংশে টেবিল বসিয়ে খাওয়ার জায়গা করা হয়েছে। মানিক খেতে খেতে স্ত্রীর করে কথা বলে, “ কি প্রচণ্ড শীতরে বাবা আজ!! তুমিা ঠিক তিনটার দিকে তৈরি থাকবে, সোয়া পাঁচটায় ট্রেন ছেড়ে দিবে। বেশি করে শীতের কাপড় নিয়ে নিয়ো কিন্তু। ঢাকার জ্যাম তো তুমি চিনোই। ট্রেন মিস করলে এইবছরও যাওয়া হবে না।” রুমি স্বামীকে আশ্বস্ত করে, “তুমি চিন্তা করো না, আমার সবকিছু গোছানই আছে। রাইয়ানকে স্কুল থেকে নিয়ে সোজা বাসায় এসে টুকিটাকি যা কিছু আছে সব ভরে ফেলব। আর তোমার কিছু ভরতে হবে নাকি?!” একটু চিন্তা করে মানিক উত্তর দেয়, “না, আমারও সব কিছু গোছানো আছে। থাকবোই কিছু ঘণ্টা, আজ রাতটা ট্রেনে, কাল ভোরে তোমাকে তোমাদের বাসায় রেখে আমি বাড়িতে যাব, জুমার নামাজটা পড়ে-খেয়ে বিকালের দিকে তোমাদের বাসায় আসবো। রাতের ট্রেনে রওনা দিবো, শনিবার সকালে পৌঁছে সরাসরি অফিসে চলে যাবো। শনিবারটা ছুটি পাওয়া গেলে ভালো হতো আর কি!! তাও দিলো না ব্যাটারা!! প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করে কুকুরেরা, নিজেকে মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরের থেকেও অধম লাগে।” স্বামীর দুরাবস্থা ভালোই বুঝতে পারে রুমি, স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “মন খারাপ করো না তো, ঢাকা শহরে থাকছি আর থাকছি মাথা উচুঁ করে। একপয়সাও ঋণ নেই কারোও কাছে আর সবচে বড় কথা আমাদের রাইয়ান দেশের সবচে ভালো স্কুলে পড়ছে, এগুলো সবই সম্ভব হয়েছে তোমার এই চাকুরীর জন্য”। এই যুক্তি সবসময়ই মানিকের মন ভালো করে দেয়। মানিক পড়াশোনা করেছে অজ পাড়াগাঁয়ের এক অখ্যাত স্কুল আর কলেজে। আর তারই ছেলে কিনা পড়ছে দেশের সবচে ভালো স্কুলে!!! প্রশান্তির নিঃশাস ফেলে মানিক রুমিকে জিজ্ঞাসা করে, “আজকে রাইয়ানের শেষ পরীক্ষা, বাবা আমার সারা বছর কতো পরিশ্রম করে, এই বেড়ানোটা ওর খুব দরকার, সবুজ মাঠ, বিশাল পুকুর, গাছ-গাছালি, পাখি, শীতের পিঠা-পায়েস সব দেখে-শুনে ভালো লাগবে ওর!” খাওয়া শেষ করে উঠে পরে মানিক। রুমি মুচকি হেসে জবাব দেয়, “তা ঠিকই বলেছ, কিন্তু ঢাকাতেই যে শীত, বাড়িতে যে কি অবস্থা?! রাইসাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। আর রাইয়ান বারবার দাদার বাড়ী আর নানার বাড়ীর কথা জানতে চেয়ে আমার মাথাটাই খারাপ করে দিচ্ছে । আজকের ড্রয়িং পরীক্ষাটা ভালো করে দিলেই আমি চিন্তা মুক্ত হই। তুমি একটু ওকে বলে যাও আস্তে আস্তে করে, ভালো ভাবে যেন আজকের পরীক্ষাটা দেয়।”
মানিক ড্রয়িংরুমে ঢুকে, রাইয়ান কার্পেটে বসে, সেন্টার টেবিলে ঝুঁকে পড়ে দ্রুত হাতে কি যেন আঁকছে। “আব্বু, আজকের পরীক্ষাটা ভালো করে দিও। কাল থেকে তো তুমি শুধু মজাই করবে!!” রাইয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে মানিক। রাইয়ান মুখ তুলে বলে, “আব্বু দেখো, আমি দাদার বাড়ী এঁকেছি। সুন্দর হইসে না?!” মানিক এক ঝলক ছবিটার দিকে তাকিয়েই বলে, “খুব সুন্দর, যাই বাবা, ভালো করে পরীক্ষাটা দিও।”
মাফলারটা দিয়ে কান ভালো করে পেঁচিয়ে মানিক ঘর থেকে বের হয়, সোয়েটার তার উপর কোট, তাও শীত মানছে না। ঢাকাতেই এতো শীত, দেশের বাড়িতে শীত নিশ্চয়ই আরও বেশী শীত। মানিক যখন ছোট ছিল তখন অবশ্য খুব বেশি ঠাণ্ডা পড়তো। ছোটবেলার শীতের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মানিক অফিসের দিকে ছোটে।
খাওয়ার টেবিলটা গুছিয়ে রুমি রাইয়ানকে নাস্তা খাওয়ায়, বেচারা এখন দাদার বাড়ি আকাঁ নিয়ে এতো ব্যস্ত যে নাস্তা খাওয়ার দিকেও মন দিতে পারে না। নাস্তা খাওয়ানোর পর রুমি ঘড়ির দিকে তাকায়, সকাল ৯টা বাজতে কিছু বাকি। হাত মুখ ধূয়ে তৈরি হতে পাঠায় রাইয়ানকে। দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত পরীক্ষা আজ। ড্রয়িং পরীক্ষা দেখে সময় দেড় ঘণ্টা।
পাঁচ বছরের রাইয়ান নিজে নিজেই স্কুলের ইউনিফর্ম পরতে পারে, মোজাও পরতে পারে, শুধু জুতার ফিতাটাই এখনও বাঁধতে পারে না। রুমি রাইয়ানের বক্স, বোর্ড গুছিয়ে, দুই বছরের রাইসাকে ঘুম থেকে উঠায়। দ্রুত নিজে রেডি হয় এবং রাইসাকে গরম কাপড়ে মুড়ে নেয়, শীতটা আসলেও একটু বেশি মনে হচ্ছে এইবার। রাইয়ানকে উলের একটা কান ঢাকা টুপি পরাতে চায় রুমি কিন্তু রাইয়ানের এটা পরতে খুব অনিহা। জোর করে রাইয়ানকে টুপিটা পরিয়ে, জুতোটা পরিয়ে, রাইসাকে কোলে নিয়ে, দরজায় তালাটা ভালো করে আটকিয়ে রুমি যখন রাস্তায় নামে তখন ঘড়িতে নয়টা বেজে সতেরো মিনিট।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে রুমির, কনকনে ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না, অল্প হেঁটে গলির মুখেই রিক্সা পেয়ে গেলো ও। এছাড়া রাইসাকে কোলে নিয়ে, রাইয়ানের হাত ধরে, নিজের শাড়ি-শাল-ব্যাগ সবকিছু ঠিক রেখে হাঁটতে হিমশিম খায় রুমি। রিক্সা চালককে হুড উঠিয়ে দিয়ে,আস্তে আস্তে সাবধানে চালাতে বলে রুমি, আজ শীত বেশি দেখে রাস্তায় ভিড়ও কম। কিন্তু রাস্তায় ভিড় কম থাকায়, যুবক রিক্সা চালক বেশ জোরেই রিক্সা টানে। রিক্সায় হুহু করে ঠাণ্ডা বাতাস আঘাত হানে, রিক্সার সল্প জায়গায় আরও গুটিসুটি মেরে বসে রুমি, ছোট রাইসাকে ডান হাতে বুকের কাছে ঠেসে, তার চাদর দিয়ে মুড়ে ধরে রাখে আর রাইয়ানের সামনে বাম হাত দিয়ে হুডটা ধরে রাখে, পাছে রাইয়ান গড়িয়ে না পরে যায়।

তৃতীয় অধ্যায়ঃ
আজ দুপুরে, বাদ জোহর সালাম মিয়ার শুভ বিবাহ। বিয়াশাদির জন্য পৌষ মাসই নাকি ভালো। সালাম মিয়া অবশ্য চাচ্ছিল আগামিকাল শুক্রবার বাদ জুমা বিয়েটা করতে কিন্তু বৃহস্পতিবারও নাকি দিন হিসাবে খারাপ না। সালাম মিয়ার ভাগ্য খুব ভালো যে মিনারার মতো মেয়েকে পেয়েছে বিয়ের জন্য। মিনারা নিজে গার্মেন্টস এ চাকরি করে, ৩০০০টাকা বেতন। আর দেখতেও খারাপ না। বস্তির সব লায়েক ছেলেরা মিনারার পিছনে লাইন ধরে থাকে। সেই মিনারা এতো ছেলেকে বাদ দিয়ে এই সালাম মিয়ারে পছন্দ করবে বিয়ের জন্য সেটা ও স্বপ্নেও ভাবেনি। সালাম মিয়া তার বাবাকে কখনো দেখেনি, মাও মারা গিয়েছে বেশ ছোট বেলায়। অপরের লাথি-গুতা খেয়েই মানুষ সালাম মিয়া। এমনি করে রাতারাতি নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে দেখে সালাম মিয়া উল্লাসিত। সালাম মিয়া একলা মানুষ, খরচপাতি তেমন নাই আর গতর খাঁটাতেও পারে ভালো আর তাই বেশ কিছু টাকা সালাম মিয়া জমিয়ে ফেলেছে। এই জমানো টাকার একটা বড় অংশ সালাম মিয়া নিজের বিয়েতে খরচ করছে। সব মিলিয়ে যেন আকাশে উড়ছে সালাম মিয়া।
এবার জব্বর শীত পড়েছে ঢাকা শহরে, শহর বন্দর জায়গায় এরকম শীত পরার ঘটনা বড়ই “আচানক”। সাধারণত, ফজরের পরেই সালাম মিয়া রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পরে। আজ জোহরের পর ওর বিয়ে, তাই বের হবে কিনা ভাবছিল সালাম মিয়া। এমনিতেই খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। অভ্যাসের কারণে ঘুম ভেঙ্গে গেছে ফজর ওয়াক্তেই। খামাখা শুয়ে না থেকে সালাম মিয়া রিক্সা নিয়ে বের হতে মনস্থির করে, কিছু টাকা তো আসবে। এছাড়া এই ঠাণ্ডাতে খুব কম রিক্সা বের হবে, যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেবার এই সুযোগটা সালাম মিয়া খোঁয়াতে চায় না। বারোটার মধ্যে বাসায় ফিরলেই হবে। এইসব ভেবে, সালাম মিয়া তার সোয়েটার আর কান ঢাকা উলের টুপিটা পরে নেয়, সবার উপরে আবার মাফলার দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে, রিক্সার গ্যারেজের দিয়ে এগোয়। গ্যারেজ পাহারায় থাকে কলিম চাচা। চাচা সারারাত ঘুমায় না, রিক্সা চোরেরা আবার খুব তক্কে তক্কে থাকে সবসময়। চাচা আগুন পোহাচ্ছিল গ্যারেজের দরজায় বসে। সালাম মিয়াকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় কলিম মিয়া। “কি রে আজও কি রিসকা নিয়া বাইর হবি?!?” সালাম মিয়া জবাব দেয়, “হঁ চাচা, তয় দুপুর হওয়ার আগেই আয়া পরমু। আর কাছেই টিরিপ লমু।” কলিম মিয়া গম্ভীর হয়ে দরজার শিকল খুলেন, “তোর যা ইচ্ছা, তোর চাচি শুনলে কইলাম রাগ করবো। আজকের দিনটা বাদ দিবার পারতি। সাবধানে গাড়ি চালাইবি আর দুপুরের আগেই আয়া পরবি কইলাম।” নিজের রিক্সাটাকে সালাম করে ওটাতে উঠে বসে সালাম মিয়া, “তুমি চিন্তা কইরো না চাচা, চাচিকে নিয়া সময়মতো পৌছায় যাইয়ো।”
সালাম মিয়ার অনুমান ঠিক হয়, সকাল নয়টা না বাজতেই তিনশো টাকার বেশি কামায়া ফেলে সালাম মিয়া। খুশিতে সালাম মিয়ার মনটা ভরে উঠে, মনে মনে ভাবে, “বউটা আমার জন্য অনেক পয়া, ঘরে পা না দিতেই রোজগারে বরকত হইতেছে!!!”
সকাল নয়টা বেজে বিশ মিনিটে সালাম মিয়ারে দেখা গেলো রাজধানীর মালিবাগ এলাকার একটা গলির মুখে। সালাম মিয়া রিক্সার পা-দানিতে বসে তখন টাকা গুনছে। এই সময় এক ভদ্রমহিলা গলি থেকে বার হয়। ভদ্র মহিলার কোলে সুন্দর একটা বাচ্চা, চেহারা দেখে মনে হয় মেয়ে আর ভদ্র মহিলার সাথে একটা ছোট ছেলেও আছে। ভদ্র মহিলা সালাম মিয়ার সাথে কথা বলে তার রিক্সায় উঠে বসে। সালাম মিয়া রিক্সা চালানো শুরু করলে ভদ্রমহিলা ওকে আস্তে আর সাবধানে চালাতে বলে। এটা শুনে সালাম মিয়া মনে মনে বলে, “চিন্তা কইরো না বনডি, আমার থেকে আস্তে আর সাবধানে গাড়ি কেউ চালাইবোনা আইজ!!!” কিন্তু পরক্ষণেই এটা ভুলে সালাম মিয়া জোরে রিক্সা টানে, রাস্তা খালি আর সালাম মিয়ার মনও এখন পালকের মতো হাল্কা!!!

শেষ অধ্যায়ঃ
সালাম মিয়া মূল রাস্তায় এসে গতি কমায়, বড় রাস্তায়ও আজ ভিড় কম। সালাম মিয়া মালিবাগ চৌরাস্তায় পৌঁছে। কোন খানেই ট্রাফিক পুলিশের দেখা না পেয়ে, দ্রুত রিক্সা চালিয়ে রাস্তাটা পার হতে চায় সালাম মিয়া। হঠাৎ সালাম মিয়া খেয়াল করে বিশাল কালো একটা জীপ সুতা কাটা ঘুড়ির মতো গোত্তা খেতে খেতে দ্রুত সালাম মিয়ার রিক্সার দিকেই ছুটে আসছে। সালাম মিয়া হাত দিয়ে জীপ গাড়ির চালকের দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যর্থ চেস্টা চালায়। অসহায় ভাবে নিজের রিক্সাটাকে বা দিকে চাপাতে চায় সালাম মিয়া, কিন্তু ওদিক থেকেও আরেকটা বড় বাসকে দ্রুত আসতে দেখা যায়। এই সময় কালো বিশাল জীপটা রুমির চোখে পরে, সব কিছু ভেঙ্গে, ছুঁড়ে ফেলে যেন ছুটে আসছে কুণ্ডলী পাকানো কোন কালো অজগর সাপ, গিলে খাবে আজ সবাইকে।
শীতের এই সুন্দর সকালটাকে নষ্ট করে দিলো এই এক্সিডেন্টের কর্কশ আওয়াজ...উফ্, এই শহরে মানুষের জীবনের কোন মূল্যই নাই। আগামিকালের সুন্দর সকালটাও নষ্ট করে দিবে আজকের এই অপ্রয়োজনীয় এক্সিডেন্টটা!!! আগামিকাল সকালের সংবাদপত্রগুলোর জন্য চমৎকার “হেডলাইন” হবে আজকের এক্সিডেন্টটা, সে বিষয়ে শহরবাসীর কোন সন্দেহ নেই!!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জ্যোতি হাসান সালেহ মাহমুদ ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা !! :) আপনি আজকের ছুটির দিনটার সকালকে আরো সুন্দর করে দিলেন!!! :) খুব ভালো থাকেন!!!
ভালো লাগেনি ২৭ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ ভয়ংকর সুন্দর গল্প। উফ্‌ আমার হার্টবিট এখনো ঠিক হয় নি। অনেক অনেক অনেক সুন্দর গল্প। পরিণতিটা ভয়ংকর অসাধারণ। একটা দুর্ঘটনা কিভাবে তিনটি পরিবারের স্বপ্নকে মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে, অকল্পনীয়। ধন্যবাদ। প্রিয়তে নিলাম। আর সেরা মার্কিং তো অবশ্যই।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১২
জ্যোতি হাসান আযাদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ!! :) আপনার মন্তব্য আমার মনটা ভালো করে দিলো!! :) খুব ভালো থাকবেন!! :)
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১২
মারুফ মুস্তাফা আযাদ ওরে বাবা! ছোট গল্পের একটা ধরন হলো সমাপ্তিটা একটা ধাক্কা দেয়। তাই বলে এতো জোরে?? ভাই এক কথায় কমেন্ট দেই, "অভুতপূর্ব"।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১২
জ্যোতি হাসান বশির আহমেদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ!! :)
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
বশির আহমেদ লেখা সাবলীল ও পরিচ্ছন্ন । সুন্দর কাহিনী বিন্ন্যাস ।
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১২
জ্যোতি হাসান মোঃ আক্তারুজ্জামান ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ!!! গল্পটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে সুখী হলাম!! ভালো থাকবেন সবসময়!! শুভকামনা রইলো!! :)
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০১২
মোঃ আক্তারুজ্জামান সাবলীল, প্রানবন্ত কথার অসাধারণ গল্প| আশা করি সবাই পড়ে দেখবেন| লেখকের প্রতি অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো|
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০১২
জ্যোতি হাসান আহমেদ সাবের স্যারকে আন্তরিক ধন্যবাদ!!! :)
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১২
আহমেদ সাবের একটা কুশলী হাতের সাবলীল গল্প। শাহাবের অন্ধ অতীত জন্ম দেয় সংবাদপত্রগুলোর জন্য একটা চমৎকার “হেডলাইন”।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

১৪ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪